বেসরকারি সংস্থাসমূহ মূলত বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কাজ করে থাকে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় এদের কার্যক্রম আরও ব্যাপ্তি ও গতি লাভ করে । বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, বিভিন্ন ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট এনজিও কাজ করছে । বাংলাদেশের কয়েকটি প্রধান এনজিও হচ্ছে ব্র্যাক, আশা, প্রশিকা, শক্তি ফাউন্ডেশন, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, টিএমএসএস, কারিতাস, সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস ও ব্যুরো বাংলাদেশ ।
১. ব্র্যাক (বাংলাদেশ রুরাল এডভান্সমেন্ট কমিটি) : ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থা হলো ব্র্যাক। দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষত নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সংস্থাটি দেশের ৭০ হাজার গ্রাম এবং ২০০০ বস্তিতে কাজ করে থাকে ।
২. স্বনির্ভর বাংলাদেশ : স্বনির্ভর বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ১৯৭৫ সালে । শুরুতে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি সংযুক্ত সেল হিসেবে কাজ করে। বেসরকারি সমাজ উন্নয়নমূলক সংস্থা হিসেবে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ শুরু করে ১৯৮৫ সালে ।
৩. প্রশিকা : ১৯৭৫ সালে ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার কয়েকটি গ্রামে কাজ শুরু করে। প্রশিকা সমিতির সদস্যদের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় পরিবেশসম্মত কৃষি, সেচ, পশুসম্পদ বৃদ্ধি, মৌমাছি পালন, মৎস্য চাষ, সামাজিক বনায়ন, বসতবাড়িতে বাগান, বীজ উৎপাদন, ক্ষুদ্র ব্যবসা ইত্যাদি কার্যক্রম চালাচ্ছে।
৪. আশা (এসোসিয়েশন্স ফর সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট) : আশা ১৯৯২ সাল হতে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে । আশা বর্তমানে আত্মনির্ভর ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
৫. শক্তি ফাউন্ডেশন : ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত শক্তি ফাউন্ডেশন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা, বগুড়া, রাজশাহীসহ অন্যান্য বড় বড় শহরের বস্তির দুস্থ নারীদের এ সংস্থা ঋণ প্রদান করে । এছাড়া, এসব নারীদের স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও সামাজিক উন্নয়নেও সংস্থাটি কাজ করে থাকে ।
৬. টিএমএসএস (ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ) : বাংলাদেশের নারী উন্নয়নে বড় সংগঠন। এই সংগঠন নারীদের দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও নারীদের ক্ষমতায়নে ১৯৮০ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
৭. এসএসএস (সোসাইটি ফর সোশাল সার্ভিসেস) : সমাজের দরিদ্র, অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত নারী-পুরুষ ও শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, অধিকার আদায় ও তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সমন্বিত সেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে ১৯৮৬ সালে এর আত্মপ্রকাশ ঘটে । সমাজের দরিদ্র, অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত নারী-পুরুষ ও শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, অধিকার আদায় ও তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন করাই এই সংস্থার লক্ষ্য ।
৮. ব্যুরো বাংলাদেশ : এই সংস্থাটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে টেকসই গ্রামীণ সঞ্চয় ও ঋণ কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য পরিচর্যা, প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন, পানি/পয়োনিষ্কাশন, পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে ।
দারিদ্র্য (Poverty )
দারিদ্র্য দেশ ও দেশের মানুষকে পরনির্ভরশীল করে তোলে। উন্নয়নের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয় । সুতরাং দারিদ্র্যের ধারণা, পরিমাপ, প্রবণতা এবং কীভাবে দারিদ্র্য নিরসন করা যায়, সে বিষয়ে জানা দরকার ।
দারিদ্র্য ধারণা (Concept of Poverty)
দারিদ্র্য একটি বহুমুখী আপেক্ষিক বিষয় ( Multidimensional and Relative). সমাজে যারা অন্যদের তুলনায় আপেক্ষিক ভাবে কম আয় করেন, কম ভোগ করেন, কম সম্পদের মালিক, কম শান্তিতে আছেন এবং সর্বদাই নিজেদেরকে অ-ক্ষমতাবান ও বিপন্ন বোধ করেন, তাদেরকেই সাধারণত দরিদ্র বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে আমরা তাদেরকেই দরিদ্র বলে থাকি, যারা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি ও ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উপকরনটুকু যোগাড় করতে পারেন না। সেরকম ন্যূনতম আয়সীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে দরিদ্র পরিবার হিসেবে ধরা হয়। দরিদ্রদের মধ্যে যারা আরো হত দরিদ্র, তাদেরকে চরম দরিদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। নিচের তালিকায় বাংলাদেশে দারিদ্র্যের পরিমাপ, হার ও গতিপ্রবণতা তুলে ধরা হলো ।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য গতিধারা (Poverty Trends of Bangladesh)
বাংলাদেশে বর্তমানে মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় পদ্ধতি দ্বারা দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয় । এ পদ্ধতিতে
দারিদ্র্যসীমা পরিমাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত (non-food) ভোগ্যপণ্য উভয়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয় । এ
অধ্যায়ে মূলত বিবিএস পরিচালিত আয় ও ব্যয় জরিপ ১৯৯৫/৯৬, ২০০৫ এবং ২০১০-এর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৪৭.৫ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে নেমে আসে অর্থাৎ দারিদ্র্য গড় বার্ষিক ১.০৬ পয়েন্ট শতাংশ হারে (Point Percentage Rate) হ্রাস পায় ।
দারিদ্র্য নিরসনে গৃহীত কার্যক্রম (Programmes Adopted for Poverty Alleviation) বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি (এনজিও) পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে । বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য নিরসনের আওতায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্ৰহণ করেছে।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি
নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীসহ সকল সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের একটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ । সামাজিক সুরক্ষা ও সামাজিক ক্ষমতায়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের আওতায় মোট ৬৪টি কর্মসূচি/কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ সমস্ত কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে নগদ প্রদান (বিশেষ ও বিভিন্ন ভাতা) কার্যক্রম, খাদ্যনিরাপত্তা কার্যক্রম, ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি ও বিভিন্ন তহবিল ।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিসমূহের শ্রেণিবিন্যাস
(ক) নগদ অর্থসহায়তা প্রদান কার্যক্রম (বিভিন্ন ভাতা);
(খ) নগদ অর্থসহায়তা প্রদান কার্যক্রম (বিশেষ);
(গ) খাদ্যনিরাপত্তা কার্যক্রম;
(ঘ) আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম